সুস্থ থাইরয়েড, সুস্থ জীবন: রুটিন চেকআপ ও সঠিক পরামর্শই প্রথম ধাপ।
বাংলাদেশে থাইরয়েড হরমোন সংক্রান্ত রোগ ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশে প্রায় ৫ কোটিরও বেশি মানুষ থাইরয়েডজনিত কোনো না কোনো সমস্যায় আক্রান্ত। কিন্তু এদের অনেকেই জানেন না তারা এই রোগ বহন করছেন — কারণ এই রোগটি অনেক সময় উপসর্গহীন বা অস্পষ্ট উপসর্গে ধরা পড়ে, ফলে গোপনে শরীরের ভেতর ক্ষতি সাধন করে।
🧠 থাইরয়েড কী ও এর ভূমিকা
থাইরয়েড গ্রন্থি গলার ঠিক সামনে অবস্থিত, দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। এটি থেকে নির্গত হরমোন শরীরের বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, শরীরের তাপমাত্রা, শক্তি উৎপাদন এবং মস্তিষ্ক ও দেহের বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে।
এই হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, যার প্রভাব পড়ে ওজন, মানসিক অবস্থা, চুল, ত্বক ও এমনকি হরমোন নিয়ন্ত্রিত প্রজনন ব্যবস্থায়ও।
🔄 থাইরয়েডের দুইটি প্রধান সমস্যা
1. হাইপোথাইরয়েডিজম (হরমোনের ঘাটতি):
- সহজেই ক্লান্ত হওয়া
- ওজন বেড়ে যাওয়া
- ঠান্ডা অনুভব
- মন-মেজাজে অবসাদ
- মাসিক অনিয়ম
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- 2. হাইপারথাইরয়েডিজম (হরমোন অতিরিক্ত):
- ওজন হ্রাস
- অস্থিরতা ও নার্ভাসনেস
- অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- ত্বকে শুষ্কতা
- হাত কাঁপা
- ঘুমের সমস্যা
👩🍼 নারী ও শিশুদের জন্য বড় ঝুঁকি
গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় ৪-৫ গুণ বেশি থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় এই রোগ না ধরা পড়লে গর্ভস্থ শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে, এমনকি স্থায়ী প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কাও থাকে।
অন্যদিকে, নবজাতকদের ক্ষেত্রে জন্মের প্রথম সপ্তাহেই থাইরয়েড স্ক্রিনিং করলে অনেক শিশুকে ভবিষ্যতের জটিলতা থেকে বাঁচানো সম্ভব। অথচ এই পরীক্ষা এখনও দেশে আইনি বাধ্যতামূলক নয়, যা একটি বড় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাগত ঘাটতি।
🧂 আয়োডিন ও পুষ্টির ভূমিকা
আয়োডিনের ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই থাইরয়েড সমস্যার অন্যতম মূল কারণ। বাংলাদেশ সরকার আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে এই সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তবুও, সঠিক থাইরয়েড কার্যকারিতার জন্য শুধু আয়োডিন নয়, খাদ্যে সেলেনিয়াম ও আয়রণ নিশ্চিত করাও জরুরি।
সুষম খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা এই রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
🏥 চিকিৎসা অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
চিকিৎসার দিক থেকে ইতিবাচক দিক হলো, বর্তমানে দেশে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ চালু হয়েছে। প্রায় ৩০০ জনের মতো হরমোন বিশেষজ্ঞ দেশে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। তবে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের জন্য এটি এখনো পর্যাপ্ত নয়।
📢 সচেতনতা ও আগাম পদক্ষেপই হচ্ছে মূল চাবিকাঠি
থাইরয়েড সমস্যা এমন একটি রোগ, যা প্রথম দিকে অনেক সময় বোঝা যায় না। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, গর্ভাবস্থায় সতর্কতা, শিশুর জন্ম পরপর স্ক্রিনিং এবং পরিমিত খাদ্যাভ্যাস — এই সবগুলো মিলে থাইরয়েডজনিত বিপদ এড়ানো সম্ভব।
সবার আগে সচেতনতা, তারপর সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ — তাহলেই এই "নীরব হুমকি" থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
লেখকঃ
ডাঃ মুসান্না সোবহান
এমবিবিএস (ঢাকা), এমডি (ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন)
এফসিপিএস (মেডিসিন) (এফ পি)
এমএসিপি (আমেরিকা)
বিশেষজ্ঞ
ইমার্জেন্সি মেডিসিন এন্ড আইসিইউ
ইউনাইটেড হসপিটাল লিঃ